খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাকে প্রতিবাদী আন্দোলন বলা হয়। এর মূলে কতকগুলি কারণ ছিল, যথা- (১) বৈদিক যুগের ..
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনের কারণ
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাকে প্রতিবাদী আন্দোলন বলা হয়। এর মূলে কতকগুলি কারণ ছিল, যথা-
(১) বৈদিক যুগের শেষের দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা খুব বড় হয়ে দেখা দেয়—যেমন দেখা দিয়েছিল ইওরোপের রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যুগে। এই নতুন চিন্তাধারার অগ্রদূত ছিলেন ‘পরিব্রাজক’ও ‘শ্রমণ' নামে পরিচিত এক সন্ন্যাসীগোষ্ঠী এবং এঁরা অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ। এঁরা গতানুগতিক পারিবারিক ও সমাজ বন্ধন তথা কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। ভারতবিদ ব্যাসামের মতে, “যে যুগে ভারতের যথার্থ ইতিহাসের আবির্ভাব হয়, সে যুগ ছিল বুদ্ধিগত ও আধ্যাত্মিক আলোড়নের যুগ। সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই নতুন সন্ন্যাসীগোষ্ঠী মানসিক শৃঙ্খলা ও উৎকর্ষের জন্য প্রচার করতে থাকেন।
(২) বৈদিক যুগের শেষের দিকে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নানা কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা এসে পড়ে। বৈদিক যুগের শেষভাগে বৈদিক আর্যদের ধর্মীয় জীবনে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই ধর্মকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বলা হয়। এই ধর্ম যাগ-যজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মীয় জীবনে প্রচণ্ড অস্থিরতার সঞ্চার হয়। ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞপূর্ণ বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের পদ্ধতি স্পর্শকাতর মানুষের মনে অত্যন্ত ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং সাধারণ মানুষের কাছে তা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। যাগ-যজ্ঞের ক্রিয়া-কর্ম এতই ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব হত না। যাগ-যজ্ঞের বিধি অনুসারে পশুবলি মানুষের মনে বেদনার উদ্রেক করে। উপনিষদে বিবৃত জীবন-দর্শন বোঝা বা তা অনুসরণ করা সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সহজ ছিল না। কারণ পুরোহিতদের সে-রকম উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞানও ছিল না। অথচ যাগ-যজ্ঞ ও পূজা-পার্বণে পুরোহিতের প্রয়োজন ছিল আবশ্যিক। ক্রমেই মানুষ বুঝতে পারে যে, কর্মফল ও জন্মান্তর থেকে মানুষকে যাগযজ্ঞ কখনই মুক্ত করতে পারে না। ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমেই কমতে থাকে এবং তারা সহজবোধ্য ও অনাড়ম্বর ধর্মের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ওল্ডেনবার্গ-এর ভাষায় "বুদ্ধের আবির্ভাবের শত শত বছর আগেই ভারতীয়দের চিন্তাধারায় এক আলোড়নের সৃষ্টি হয় যা বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবের পথ রচনা করে।"
(৩) বৈদিক যুগের শেষের দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা খুব বড় হয়ে দেখা দেয়—যেমন দেখা দিয়েছিল ইউরোপের রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যুগে। এই নতুন চিন্তাধারার অগ্রদূত ছিলেন পরিব্রাজক ও শ্রমণ নামে পরিচিত এক সন্ন্যাসীগোষ্ঠী। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন অ-ব্রাহ্মণ। এঁরা গতানুগতিক পারিবারিক ও সমাজ বন্ধন তথা কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। এই শ্রমণেরা সংসার ও কর্মফলে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁরা ব্রাহ্মণদের বর্ণ-শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ও বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করেন এবং মোক্ষলাভের জন্য অহিংসা ও সদাচরণের কথা প্রচার করেন। জীবনের মৌল সমস্যা সম্বন্ধে এই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের ধ্যান-ধারণা বেদভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিতটি দুর্বল করে ফেলেছিল প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিবাদী আন্দোলনের মূলে ছিল এক নতুন ” দার্শনিক চিন্তা।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমালোচনার জন্য খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় অব্দের মধ্যে আজিবিকরা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং নিম্নশ্রেণীর মানুষের ওপর খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। সুতরাং প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের পূর্বেই আজিৱিক ধর্ম সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল দেখা যায়।
(৪) প্রতিবাদী আন্দোলনের মূলে সামাজিক কারণও ছিল : ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মতো ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজেও নানা সংকীর্ণতা ও অনাচার এসে পড়ে। ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ও সামাজিক মর্যাদা সাধারণ মানুষ তথা রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষত্রিয়দের কাছে অহেতুক বলে মনে হয় এবং তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। বৈদিক যুগের শেষের দিকে বিভিন্ন বর্ণ ও জাতির মধ্যে বর্ণগত বৈষম্য তীব্র হয়ে ওঠে। সমাজের সর্বোচ্চ শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণরা সর্বোচ্চ সামাজিক কারণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণদের অনাচার ও
ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমাজে নানা দুর্নীতি এসে পড়ে। তাঁরা পূজা-পার্বণ, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতি নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে কুসংস্কারের মাত্রা বাড়িয়ে তোলেন।
ধর্মের নামে প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে তাঁরা বিলাস-ব্যসনেই বেশী মগ্ন থাকতেন। নানা ধরনের কুসংস্কারে উৎসাহ দিয়ে ও মন্ত্রের সাহায্যে মানুষের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ভাণ করে ব্রাহ্মণরা সব শ্রেণীর মানুষের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতেই বেশী সচেষ্ট থাকতেন। রাষ্ট্রকে তাঁরা কোন কর দিতেন না এবং গুরু অপরাধেও তারা শাস্তি পেতেন না। অথচ করভাবে ও শ্রমভারে বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি বর্ণের মানুষ ছিল জর্জরিত। সমাজে ব্রাহ্মণদের পরেই ক্ষত্রিয়দের স্থান ছিল। বিভিন্ন ছোট-বড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা করে ক্ষত্রিয়রা প্রভৃত ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণদের সমমর্যাদা ক্ষত্রিয়রা তখনও অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তির প্রতিবাদে ক্ষত্রিয়রাও সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনে ক্ষত্রিয়রাই নেতৃত্ব দিয়েছিল ।
বৈশ্য শ্রেণীর মানুষরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যের দ্বারা ক্রমেই বিত্তশালী” হয়ে উঠছিল। তারাই রাষ্ট্রীয় করের বোঝা বহন করত। কিন্তু রাষ্ট্রে ও সমাজে তাদের মর্যাদা ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের তুলনায় অনেক কম। শূদ্ররা ছিল প্রথম তিন শ্রেণীর মানুষের সেবায় নিযুক্ত এবং তাদের অপবিত্র বলে মনে করা হত। জাতিভেদ প্রথার ফলে বৈশ্য ও শূদ্রদের সমাজে কোন মর্যাদা ছিল না। সুতরাং ক্ষত্রিয়দের মতো বৈশ্য ও শূদ্ররাও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
(৫) খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লোহার ব্যবহার খুবই বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে কৃষির উপযোগী যন্ত্রপাতিও। এর ফলে বহু নতুন নতুন এলাকায় চাষ-আবাদের প্রসার ঘটে। কৃষির প্রসারের ফলে উৎপাদন বেড়ে যায়, কৃষকদের হাতে অর্থের সমাগম হতে থাকে। কৃষির প্রসারের ফলে সমকালীন অর্থনীতির বিরাট পরিবর্তন ঘটে। কৃষিকার্যের জন্য পশু-পালনের প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়। কিন্তু পশু-বলিদান ছিল যাগ-যজ্ঞের তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এক অপরিহার্য অঙ্গ।
যাগ-যজ্ঞে পশুবলি দেওয়ার জন্য বৈশ্যদের কাছ থেকে গো-সম্পদ নিয়ে যাওয়া হত, বিনিময়ে তারা ক্ষতিপূরণ পেত না। ফলে বৈশ্যদের পেশা সংকুচিত হয়ে আসছিল। আবার পশুবলি যাগ-যজ্ঞের অন্যতম অঙ্গ হওয়ার ফলে পশুসম্পদ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল। নতুন কৃষি অর্থনীতিতে গো-সম্পদের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল । সুতরাং, কৃষি অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য পশুবলি প্রথা বন্ধ করার প্রয়োজন অনুভূত হয় । সুতরাং গো-সম্পদ রক্ষার তাগিদে কৃষক তথা বৈশ্যরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে নতুন নতুন নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। উত্তর ভারতে বহু বাণিজ্যপথ উন্মুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যের চলাচল ক্রমেই বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে দক্ষিণ-ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্যের লেনদেনও বেড়ে যায়।
সুতরাং বলা যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বিবর্তন, নাগরিক ও শিল্পী-কারিগর শ্রেণীর উদ্ভব, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ভারতের ধর্মজীবনে এক গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নগরের নতুন নাগরিক গোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীলতার সংঘর্ষ থেকেই নানা দার্শনিক মতবাদ ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এবং শেষ পর্যন্ত জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। ইওরোপে যেমন ক্যাথলিক ধর্ম ও পোপের বিরুদ্ধে Protestant বা প্রতিবাদী ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, তেমনি ভারতে বৈদিক ধর্ম ও ব্রাহ্মণদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব হয়।
COMMENTS